স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে দেখি, আমার সহপাঠীরা বাসায় গিয়ে তেমন পড়ে না।
ইউনিভার্সিটি শেষে দেখতাম ওরা পার্টিতে চলে যায়। যতো কঠিন
পরীক্ষাই হোক, ওরা উইকেন্ডে আনন্দ বাদ দিয়ে, পরীক্ষার জন্য
পড়তে চায় না।
আমার কাছে বিষয়টা প্রথম প্রথম অদ্ভুত লাগতো। যেহেতু,
আমি বাংলাদেশের কালচারে বড়ো হওয়া।
আমার সহপাঠীদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা বাসায়
গিয়ে তেমন স্টাডি করো না? ওরা উল্টো আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো—বাসায় গিয়ে যদি পড়ি,
তাহলে স্কুলে (ইউনিভার্সিটি) আসি কেন? এখানে তো পড়তেই আসি!
ভাবলাম, কথায় তো যুক্তি আছে। আমাকে বললো, তুমি যদি
স্কুলেই ৭-৮ ঘন্টা কাটাও, এটা তো পড়াশুনার জন্যই। তাইলে আবার বাসায় গিয়ে কখন পড়বে?
কেন পড়বে?
আমি চিন্তা করলাম—আমাদেরকে এভাবে কখনো বলেনি কেন? এভাবে ভাবতে
শেখায়নি কেন?
স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উল্টো আমাদেরকে বলা
হয়েছে—পড়ো। সারাদিন পড়ো। দুনিয়ার কোন কিছু চিন্তা না করে শুধু পড়ো। আদা-জল
খেয়ে পড়ো। ঘুম, খাওয়া আর বাথরুম ছাড়া শুধু পড়ো। ভোর বেলায় উঠে পড়ো—তখন
মাথা ঠাণ্ডা থাকে। গভীর রাতে পড়ো। পড়তে পড়তে গায়ের জামা-কাপড়ের কথাও ভুলে যাও।
১২-১৪ ঘন্টা পড়া, আর পরীক্ষার সময় ৬-৭ টা লুজ পেপার নেয়া
হলো—আমাদের স্ট্যান্ডার্ডে একটা পড়ুয়া স্টুডেন্টের লক্ষণ!
যাই হোক, পরে আরো গভীরভাবে জেনে দেখলাম, ওরা তো
ছোটবেলা থেকেই এই চর্চায় বড়ো হয়। স্কুলে যায় পড়তে। শিখতে। স্কুলে বসেই শিখে। ফলে
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও একই চর্চার ধারাবাহিকতা থাকে। কেউ কেউ যে একটু বেশি পড়ুয়া
হয় না, তা না। কিন্তু গড় চিত্রটা এমনই। বিদ্যাপীঠে তো পড়তেই যায়, তাহলে বাসায়
এসে কেন আদা-জল খেয়ে পড়বে?
এখন আমার ছেলেকে দিয়ে বুঝি। কোন প্রাইভেট নাই। বাসায় এসে
পড়ার চাপ নাই। এমনকি হোম ওয়ার্কও তেমন দেয় না। যদিও, আমি ওকে বাসায়
মাঝে মাঝে কিছুটা শিখাই।
আমি ওর ক্লাস টিচারকে জিজ্ঞেস করলাম—ওদেরকে প্রতিদিন হোম
ওয়ার্ক দাও না কেন? টিচার বললো, বোর্ড থেকে নিষেধ আছে। বাচ্চারা যেনো বাসায়
গিয়ে পড়ার চাপে আগ্রহ না হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ “বার্ন আউট” না হয়, সেজন্য। সে
নিজেই বললো, স্কুলে তো ওরা শিখতেই আসে। এখানেই যদি না শিখে—তাইলে
স্কুলের দরকারটা কি? It defeats the purpose!
মনে মনে বলি—শালার পড়াশুনা এরাই করলো! প্রাইভেটের
দৌঁড়াদৌঁড়ি নাই। বইয়ের বোঝা ভর্তি চাপ নাই। হোম ওয়ার্কের তীব্র প্যারা নাই।
বাসায় কেউ বলে না—পড়তে বসো। আবার এরাই দুনিয়ার সব আবিষ্কার-উদ্ভাবন করে বসে থাকে।
আর আমরা বীজতলা ঠিক না করে, বীজতলার দোষ
না দিয়ে—প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু পড়েই গেলাম! এভাবে পড়েই যাবো। গোড়ার গলদটুকু
কখনোই সমাধান করবো না।
No comments:
Post a Comment